মিলন কর্মকার রাজু।।
“সাগরে যাইয়া এ্যাহন আর জীবন চলে না, এ্যাহন আমাগো শান্তি এই ফষলের মাঠে। ট্রলার ডুইব্বা মরার ভয় নাই। জলদস্যুগো মাইর খাইতে হয়না। মাছ ধইর্যা জেল খাডার চিন্তা নাই।” এ কথাগুলো বলেন পঞ্চাশোর্ধ নেয়ামত আলী। দীর্ঘ ২৫ বছর সাগর ও নদীতে মাছ শিকার করলেও তিনি এখন পুরোদস্তুর কৃষক। বিস্তীর্ণ বালুচরে ফষল ফলানোই এখন তার স্বপ্ন। কলাপাড়ার ধুলাসার ইউনিয়নের সাগরের বুকে জেগে ওঠা কাউয়ার চরে তার মতো এখন শতশত জেলে উপক‚লের ব্যস্ত কৃষক।
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ কাউয়ার চর গ্রামের মানুষ বর্ষা জুড়ে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এখন কৃষি উৎপাদনে নেমেছে বালুচরের বুকে। এখানকার মানুষ প্রতিটি নির্বাচনেই ভোট দিলেও নাগরিক সুবিধা থেকে তারা সবসময়ই বঞ্চিত। তাই ধূ ধূ বালুচরে তারা এখন কৃষি বিপ্লব শুরু করেছে। দূর্গম কাউয়ার চরের “মৃত্যুক‚পে” হাজারো পরিবার ঝড়,জলোচ্ছাস থেকে তাদের জীবন রক্ষায় এখন নিজেরাই নির্মান শুরু করেছে প্রাকৃতিক সবুজ দেয়াল।
প্রকৃতির বার বার আঘাতে বিপর্যস্ত এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলো এখন নিজেরাই পাল্টিয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। গোটা চরে এখনও নির্মান হয়নি পাকা রাস্তা, প্রটেকশন বাঁধ ও আশ্রয় কেন্দ্র। নেই বিদ্যুত কিংবা সুপেয় পানির ব্যবস্থা। তারপরও সেই ধংসস্তুপের মধ্যে হাজারো মানুষ নির্মান করেছে তাদের স্বপ্নের কুঁড়ে ঘর।
চল্লিশোর্ধ রেনু বেগমের জন্ম কাউয়ার চর গ্রামে। এই চরের ক্ষুদ্র জেলে মো.রফিকের সাথে প্রায় ২৩ বছর আগে বিয়ে হলেও নিঃসন্তান। ঝড়-জলোচ্ছাসে তার দু’বার তার বসত ঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও এই চরেই খড়কুটোর মতো এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে গড়েছেন মাথা গোঁজার আশ্রয়। এখন বাড়ির চারপাশে লাগিয়েছেন বিভিন্ন প্রজাতির দ্রæত বর্ধনশীল গাছ। এই রেনু পোনা শিকারী সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় এখন ব্যস্ত সময় পার করছে আমন চাষাবাদে। চরে তিন একর জমিতে আমনের চাষ করেছেন। তার মতো এ চরের শতাধিক গৃহবধু এখন পোনা শিকার বাদ দিয়ে কৃষি কাজ ও কৃষি শ্রমিকের করছেন। তাদের কাছে কৃষিই এখন তাদের জীবিকার প্রধান উৎস।
রেনু বেগম বলেন, এ্যাহন আর সাগরে মাছ নাই। দুইডা, চাইরডা পোনা ধরতাম। কিন্তু হেইয়া ধরাও বন্ধ কইর্যা দেছে। মাছ ধরতে গেলে জাল,নৌকা লইয়া যায়। তাই মোরা এ্যাহন আর পোনা ধরি না। তিনি বলেন “ মোগো এই চরের সব ঘরই খড়ের ঘর। ঝড় হইলেই আর রক্ষা নাই। তাই ঝড়ো বাতাস থেকে ঘর রক্ষা করতে বাড়ির চাইরপাশে গাছ লাগাইছেন। চরে সাইক্লোন সেন্টার নাই। টিভিতে দেখছেন বাড়ির পাশে গাছ লাগাইলে রক্ষা পাওয়া যায় বইন্না থেইক্কা। হেইয়ার লাইগ্যা সবাই মোরা গাছ লাগাই”।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ছয় বছর আগেও এই চরে সাগরের জোয়ার-ভাটায় পানি প্রবাহিত হলেও এখন বালু চরের উচ্চতা চার-পাঁচ ফুট বেড়ে গেছে। বর্ষায় সাগরের পানির উচ্চতা চরের নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হলেও সারা বছরই চরে এখন চাষাবাদ হয়। মাত্র কয়েক বছরে এই বালুচর এখন তিন ফষলী জমিতে পরিনত হয়েছে। পেশা পাল্টে জেলেরা এখন কৃষি কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
কাউয়ার চরের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, “তিন বছর আগে মাছ ধরা বাদ দেছেন। দুই বার ট্রলার ডুইব্বা মরতে মরতে বাইচ্চা গ্যাছে। আর সাগরে এ্যাহন আর মাছও নাই। হেইয়ার লাইগ্যা আড়াই একর জমি লিজ নিয়া এ্যাহন চাষ করেন। ধানের সিজনে ধান। ডালের সিজনে ডাল আর তরমুজের সিজনে তরমুজ। ২৫/৩০ হাজার টাহা খরচ হইলেও আল্লায় দেলে কয়েক লাখ টাহার তরমুজ ও ডাইল বিক্রি করছি। আর এ্যাহন ধান দিছি। দেহি আল্লায় কি দেয়। এ কৃষকদের মতো এক সময়ে জেলে সোবাহান মিয়া, আলম, আলাউদ্দিন, বশির মোল্লা এখন পুরোদস্তুর কৃষক।
কৃষক মোহাম্মদ আলী জানান, কাউয়ার চরের অন্তত পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষ এখন কৃষি কাজ করছেন। কেননা সাগরে মাছ ধরলে এখন সংসার চলেনা। তাই চরের বুকে র চাষাবাদ নিয়েই এখন তারা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন।
একাধিক কৃষক বলেন, তারা ফষল ফলান, কিন্তু বেঁচতে হয় পানির দরে। এখানে ফষল বিক্রির বাজার না থাকায় এবং ফষলের সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
কলাপাড়ার মহীপুর ভ‚মি অফিস সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছরই প্রায় এক-দেড়শ একর খাস জমি একসনা বন্দোবস্ত দেয়া হচ্ছে চরাঞ্চলের কৃষকদের। আগে চরের বাসিন্দারা শুধু মাছ শিকার করলেও এখন কৃষিতে নিয়োজিত হচ্ছে।