বিধিমালা অনুযায়ী তালিকাভুক্ত ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন এসব স্থাপনা ও এলাকায় অবস্থিত ইমারত, উন্মুক্ত জায়গা, রাস্তা ও গলির প্রকৃত অবস্থার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংস্কার, অপসারণ ও ধ্বংস করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোনো সংস্থার মালিকানাধীন কোনো স্থাপনা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত হলে তা পরিবর্তন, সংস্কার ও অপসারণ করতে নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমতি নেওয়া আবশ্যক করা হয়। বিধিমালা শক্ত হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন।
হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত ৯৩টি স্থাপনার বেশিরভাগই সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধাসরকারি ও বেসরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন। পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক এলাকাগুলো হচ্ছে- ফরাশগঞ্জ অঞ্চলের ফরাশগঞ্জ রোড, ঋষিকেশ রোড, রেবতিমোহন দাস রোড, বি কে দাস রোড; শাঁখারীবাজারের শাঁখারীবাজার রোড, তাঁতীবাজার রোড ও পনিতলা রোড; সূত্রাপুরের হেমন্ত দাস রোড ও প্যারিদাস রোড এবং রমনা অঞ্চলের বেইলী রোড, মিন্টো রোড, হেয়ার রোড ও পার্ক অ্যাভিনিউ। এসব এলাকার স্থাপনা, সড়ক, গলি ও উন্মুক্ত স্থানও গুরুত্বপূর্ণ হেরিটেজ হিসেবে বিবেচিত।
সূত্রাপুর, ফরাশগঞ্জ ও শাঁখারীবাজারের অবস্থান পুরান ঢাকায়। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, এসব অঞ্চলে গেজেটে উল্লিখিত ঐতিহ্যের চিহ্নমাত্র নেই। বাংলাবাজার হয়ে প্যারিদাস রোডে যেতে দুপাশে চোখে পড়ে কেবল আধুনিক স্থাপনা। হাতে গোনা দু-একটা পুরনো ভবন ম্রিয়মাণ নতুন ভবনগুলোর মাঝে। প্যারিদাস রোডের ৫০ থেকে ৫৮ নম্বর হোল্ডিংগুলো রাস্তার উত্তরপাশে। এ ৯টি হোল্ডিংয়ের কেবল ৫১ ও ৫২ নম্বরে দুটি পুরনো স্থাপনা আছে। একই চিত্র প্যারিদাস রোডসংলগ্ন বিভিন্ন অলি-গলিতেও। প্যারিদাস রোডের একটি গলি রূপচান লেন। এই লেনের ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের পুরনো বাড়ি ভেঙে ছয়তলা ভবন গড়ছে রশীদ রিয়েল এস্টেট নামের প্রতিষ্ঠান। ভবনের কাজ শেষ না হলেও অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইব্রাহিম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্যারিদাস রোড হেরিটেজ হলেও রোড থেকে ২০০ মিটার দূরে তাদের প্লট। তাই এটা ভেঙে নতুন ভবন করতে কোনো সমস্যা নেই। হেরিটেজ স্থাপনার পাশাপাশি অঞ্চলের ক্ষেত্রেও বিধি প্রযোজ্য কি না— জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি।
একই রোডের ঈশ্বর দাস লেনের ৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের পুরনো ভবন ভেঙে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন ভবন। প্যারিদাস রোড দিয়ে রূপচান লেনে ঢুকতে পুরনো স্থাপত্যের একটি বিশাল বাড়ি ভাঙা হয়েছে সেখানে নতুন ভবন তৈরির জন্য।
প্যারিদাস রোডের পরেই হেমেন্দ্র দাস রোড। এ রোডের ১ থেকে ৩ নম্বর হোল্ডিং ছাড়া বাকি সবই নতুন ভবন। এসব ভবন নির্মাণে রাজউক বা নগর উন্নয়ন কমিটির কোনো অনুমোদন নেই। ওই রোডে ১৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের শরীফ মো. আবদুর রহমান বলেন, পৈতৃক সূত্রে এই বাড়ির মালিক আমরা তিন ভাই। ২০০৮ সালে নতুন ভবনের কাজ শুরু করি। শেষ হয় ২০১২ সালে। পরে আমরা জানতে পারি, ২০০৯ সালে এসব বাড়িকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হেরিটেজ হওয়ার কারণে রাজউকের কাছে গিয়ে ঝামেলায় পড়ার আশঙ্কায় অনুমোদনের ধার ধারছেন না কেউই।
এদিকে, ২০০৪ সালে পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারে ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হলে ঢাকা সিটি করপোরেশন কারিগরি জরিপের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত ও তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। প্রথমে ১১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে পাইলট প্রকল্প হিসেবে জরিপ শুরু করে। জরিপের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে কিছু ভবন এবং ঐতিহ্যবাহী নয় কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এমন কিছু ভবনের তালিকা করে। পাইলট প্রকল্পে শুধু শাঁখারীবাজারেই ঐতিহ্যবাহী ও ঝুঁকিপূর্ণ ৯৫টি ভবন শনাক্ত হয়। আর বীরেন বোস স্ট্রিটে ঐতিহ্যবাহী নয় কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এমন ভবন শনাক্ত হয় ১৮টি।
কী আছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় : ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা-২০০৮-এর ৬১ বিধির (চ), (ছ), (জ) ও (ঝ) উপবিধির মাধ্যমে এসব সংরক্ষিত ভবন, স্থাপনা ও এলাকার সংস্কার এবং ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। উপবিধিতে কর্তৃপক্ষের (নগর উন্নয়ন কমিটি) লিখিত অনুমতি ছাড়া তালিকাভুক্ত ইমারতের কোনো প্রকার পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বা ধ্বংসসাধন না করা, এ কাজের জন্য নগর উন্নয়ন কমিটির লিখিত অনুমতি নেওয়াসহ বিভিন্ন বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এই বিধিমালার কোনো প্রয়োগই নেই। আর হেরিটেজ ঘোষণা করা সংস্থা স্বয়ং রাজউকই দায় এড়িয়ে চলছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাউজক) উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, হেরিটেজ ঘোষণা করেছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আর হেরিটেজ রক্ষায় নগর উন্নয়ন কমিটি রয়েছে, অন্যান্য সংস্থার মত রাজউকও ওই কমিটির সদস্য। হেরিটেজ রক্ষায় আমাদের একার কিছু করার নেই। তবে আমরা হেরিটেজ ঘোষিত অঞ্চলের ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই করে থাকি। আর অভিযোগ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা হেরিটেজ ধ্বংসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।
এ ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার পুরনো স্থাপত্যগুলো শুধু রাজধানীরই নয়, দেশের ঐতিহ্য। দীর্ঘদিন ধরে এগুলো সংরক্ষণের দাবি জানানো হলেও ২০০৯ সালে একটি দায়সারা গেজেট প্রকাশ করে রাজউক। হেরিটেজ স্থাপনা বা অঞ্চলগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কৌশলে এড়িয়ে তারা শুধু তালিকা করেই খালাস। যেখানে ব্যবসা আছে সেখানে রাজউক, আর যেখানে খরচ ও দায়িত্ব আছে সেখানে প্রতিষ্ঠানটিকে খুঁজেও পাওয়া যাবে না বলেও মন্তব্য করে তিনি।
সূত্র-বাংলাদেশের খবর