মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া(পটুয়াখালী)।।
“রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে,আমরা যাবো কোন দেশে ?” ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রিভা(১১) এভাবে হাতে প্লাকার্ড মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে প্রচন্ড রোদে দাড়িয়ে আছে টানা পাঁচ ঘন্টা। বেঁচে থাকা ও শিক্ষা গ্রহনের শেষ সম্বলটুকু হারানোর শঙ্কায় দু’চোখ বেয়ে কষ্টের অশ্রæ ঝরলেও বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার দাবিতে এভাবেই সে দাড়িয়ে থাকে। তার কষ্ট যন্ত্রনা দেখে রিভার পাশে প্রতিবাদে অংশ নেয় তার সহপাঠী ও অভিভাবকরাও।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার ধানখালী ইউনিয়ন পরিষদের রসামনে এ স্কুল ছাত্রীর রিভার মতো বসত ভিটা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষার অন্দোলনে তার সহপাঠীসহ শতশত শিক্ষার্থী অংশ নেয় বৃহস্পতিবার (৮ নভেম্বর) দুপুরে।
স্থানীয়রা জানান, লোকশ্রæতি রয়েছে ষোল দরুণ এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সনাতন ধর্মের অনুসারী বাস করতা এই দেবপুর গ্রামে। তৎকালীন সময়ে পূজা অর্চনার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামটির নামকরণ হয় আজকের দেবপুর। এ গ্রামে রয়েছে ছয়শ কৃষক পরিবার, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাতটি মসজিদ, শতাধিক মৎস্য খামার। ইতিমধ্যে আগুনমুখো নদীর ভাঙ্গনে ২৮ শ একর জমি নিয়ে দেবপুর গ্রামটি এখন অবিশিষ্ট রয়েছে ৮৯২ একর। কৃষিতে সমৃদ্ধ এ গ্রাম সহ পাশ্ববর্তী পাঁচজুনিয়া গ্রামে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের জন্য ১০০০ একর তিন ফষলী জমি অধিগ্রহনের জন্য গ্রামবাসীদের তিন ও ছয় ধারায় নোটিশ প্রদান করেছে। এ জমি অধিগ্রহনেরর কারনে সর্বস্ব হারানোর আশংকায় উদ্বিগ্ন রিভার পরিবারের মতো হাজারো মানুষ।
জানাযায়, ধানখালী ইউনিয়নে বর্তমানে নর্থ ওয়েষ্ট ১৩২০ মেঘাওয়াট, আরপিসিএল ১৩২০ মেঘাওয়াট ও সিমেন্স ৩৬০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য প্রায় দুই হাজার একর জমি অধিগ্রহন করেছে। একইভাবে আশুগঞ্জ কোম্পানী পাঁচজুনিয়া ও দেবপুর গ্রামের উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ অধিগ্রহনের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় দফা নোটিশ প্রদান করেছে। বাকি জমি অবশিষ্ট আছে তা সেনাকল্যান সংস্থা অধিগ্রহন করার চেষ্টা করছে। এ দুই কোম্পানী ও সংস্থার যাতে জমি অধিগ্রহন করতে না পারে এজন্য বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে গ্রামবাসীরা আবেদন করেছে। কিন্তু তাদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা কমেনি।
দক্ষিন দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মোস্তফা মেহেদী তুহিন বলেন, ভ‚মি রক্ষার আন্দোলনে দুই ইউনিয়নের চারটি গ্রামের ১৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকরা অংশ নিয়েছে। সবার দাবি আমরা রোহিঙ্গা হতে চাই না, বাঙালী থেকে নিজগৃহে সুখে থাকতে চাই, পড়তে চাই। এ দাবি করে দুই ইউনিয়নের মানুষ একজোট হয়ে এ ভ‚মি রক্ষা আন্দোলনে নেমেছে।
আন্দোলনে অংশ নেয়া রিভা ধানখালী আশরাফ একাডেমির ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। বাবা আব্বাস মোল্লা প্রতিবন্ধী। তার ডান হাতটি এক দূর্ঘটনায় কেটে ফেলতে হয়েছে শৈশবে। রিভার বড় ভাই হৃদয় দশম শ্রেণির ছাত্রী। মা রাহিমা বেগমের কোলে দুই বছরের ছোট্র বোন হুমামা। তিন সন্তান ও স্ত্রীর ভরন পোষনের জন্য একহাতেই সংগ্রাম করতে হচ্ছে আব্বাস মোল্লাকে। সম্পত্তি বলতে শুধু বসত ঘর। গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে আব্বাস মোল্লা মাসে যে কয়টাকা উপার্জণ করেণ তা দিয়ে কোনমতে চলে সংসার। কিন্তু হঠাৎ করে শুনতে পান তাদের বসত ঘরটিও বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের জন্য অধিগ্রহন করা হবে।
কলাপাড়ার চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর গ্রামের বসত ঘরটি হারানোর শঙ্কায় উদ্বিগ্ন রিভার বাবা-মায়ের পাশে দাড়াতে গ্রামের হাজারো মানুষের সাথে কয়েক কিলোমিটার সড়ক পায়ে হেঁটে তিন ফষলী জমি, বসত ঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষার অন্দোলনে হাতে হাত ধরে তাই রিভাও দাড়িয়েছে আন্দোলনে।
রিভা জানায়, আব্বার তো একটা হাত নাই। কোন কামকাইজ করতে পারে না। গ্রামে গ্রামে ঘুইর্যা পোলাপান পড়ায়। থাহার মধ্যে আছে আমাগো খালি ঘরডাই। এ্যাহন যদি হেইয়াও লইয়া যায়,তাইলে আমরা কই থাকমু। বাবা-মা ও ভাই আইতে পারে নায় আন্দোলনে। আমাগো ঘর দিয়া আমি আইছি। ঘর রক্ষা না কইর্যা আর বাড়ি ফিরমু না।
রিভার আর্তি, আমাগো ঘরডা লইয়া গ্যালে হয়তো কয়ডা টাকা পামু। কিন্তু আমরা তিন ভাই-বোন, আব্বা-আম্মা কই থাকমু। এই গ্রামে আছি দেইখ্যা বাবা প্রাইভেট পড়াইতে পারে। অন্যহানে গ্যালে তো আমাগো না খাইয়া মরতে হইবে। তহন কেডা দ্যাখবে আমাগো। আমরা কোন স্কুলে যামু।
রিভার ভাবি হেলেনা বেগম বলেন, স্কুল পড়–য়া দুই সন্তান নিয়ে তিনিও এসেছেন রিভার সাথে আন্দোলনে। কৃষি কাজ করে চলে তাদের সংসার। এখন যদি সেই চাষের জমিটুকুই বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে তারা বাঁচবেন কিভাবে ?